শশাংকের মৃত্যুর পর বাংলার ইতিহাসে এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয় । দীর্ঘদিন বাংলায় কোনো যোগ্য শাসক ছিলেন না । ফলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়। একদিকে হর্ষবর্ধন ও ভাস্কর বর্মণের হাতে গৌড় রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, অন্যদিকে ভূস্বামীরা প্রত্যেকেই বাংলার রাজা হওয়ার কল্পনায় একে অন্যের সাথে সংঘাতে মেতে ওঠে। কেন্দ্রীয় শাসন শক্ত হাতে ধরার মতো তখন কেউ ছিল না। এ অরাজকতার সময়কালকে ধর্ম পালের ‘খালিমপুর তাম্রশাসনে আখ্যায়িত করা হয়েছে 'মাৎস্যন্যায়' বলে । পুকুরে বড় মাছ ছোট মাছকে ধরে গিলে ফেলার মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলে 'মাৎস্যন্যায়'। বাংলার সবল অধিপতিরা এমন করে ছোট অঞ্চলগুলোকে গ্রাস করছিলেন। এ অরাজকতার যুগ চলে একশ' বছরব্যাপী। অষ্টম শতকের মাঝমাঝি এ অরাজকতার অবসান ঘটে পাল রাজত্বের উত্থানের মধ্য দিয়ে ।
দীর্ঘদিনের অরাজকতায় বাংলার মানুষের মন বিষিয়ে গিয়েছিল। এ চরম দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি লাভের জন্য দেশের প্রবীণ নেতাগণ স্থির করলেন যে, তারা পরস্পর বিবাদ-বিসম্বাদ ভুলে একজনকে রাজপদে নির্বাচিত করবেন এবং সকলেই স্বেচ্ছায় তাঁর প্রভুত্ব স্বীকার করবেন । দেশের জনসাধারণও এ মত সানন্দে গ্রহণ করে । এর ফলে গোপাল নামের এক ব্যক্তি রাজপদে নির্বাচিত হলেন। পরবর্তী শাসক ধর্মপালের রাজত্বকালে উৎকীর্ণ খালিমপুরের তাম্রলিপি থেকে গোপালের এ নির্বাচনের কাহিনি পাওয়া যায় ।
গোপালের পূর্ব জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। পাল বংশের পরিচয় ও আদি বাসস্থান সম্পর্কেও স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। গোপালের পিতার নাম বপ্যট । পিতামহ ছিলেন দয়িতবিষ্ণু । তাদের নামের আগে কোনো রাজকীয় উপাধি দেখা যায়নি । এতে মনে করা হয়, তারা সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। গোপালের সিংহাসনে আরোহণের মধ্য দিয়ে বাংলায় পাল রাজত্বের শুরু হয়। পাল বংশের রাজাগণ একটানা চারশ' বছর এদেশ শাসন করেন। এত দীর্ঘ সময় আর কোনো রাজবংশ এদেশ শাসন করেনি । গোপাল সিংহাসনে আরোহণ করে রাজ্য বিস্তারে মনোযোগ দেন। তিনি বাংলার উত্তর এবং পূর্ব অংশের প্রায় সমগ্র অঞ্চলই রাজ্যভুক্ত করেন। অনেকের মতে গোপাল ২৭ বছর শাসন করেছিলেন। কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ মনে করেন, তিনি ৭৫০ থেকে ৭৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশ শাসন করেন ।
গোপালের মৃত্যুর পর ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সিংহাসনে বসেন। পাল রাজাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ । বাংলা ও বিহারব্যাপী তাঁর শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল । উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ সময়ে তিনটি রাজবংশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। একটি বাংলার পাল, অন্যটি রাজপুতনার গুর্জরপ্রতিহার ও তৃতীয়টি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট । ইতিহাসে এ যুদ্ধ ‘ত্রি-শক্তির সংঘর্ষ' বলে পরিচিত । আট শতকের শেষ দিকে এ যুদ্ধ শুরু হয় । প্রথম যুদ্ধ হয় ধর্মপাল ও প্রতিহার বংশের রাজা বৎসরাজার মধ্যে । এ যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন । তবুও ধর্মপাল এ সময় বাংলার বাইরে বেশকিছু অঞ্চল জয় করেছিলেন । তিনি বারাণসী ও প্রয়াগ জয় করে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। ত্রি-শক্তির সংঘর্ষের প্রথম দিকে ধর্মপাল পরাজিত হলেও তাঁর বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ বিজয়ের পর রাষ্ট্রকুটরাজ দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান। এ সুযোগে ধর্মপাল কনৌজ অধিকার করেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিহাররাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজ দখল করেন। ফলে ধর্মপালের সাথে তাঁর যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন। এ পরাজয়েও ধর্মপালের কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ পূর্বের মতো রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারতে আসেন এবং দ্বিতীয় নাগভঙ্গকে পরাজিত করেন। প্রতিহার রাজের পরাজয়ের পর ধর্মপালও তৃতীয় গোবিন্দের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। অতঃপর রাষ্ট্রকূটরাজ তাঁর দেশে ফিরে গেলে ধর্মপাল পুনরার উত্তর ভারতে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করেন। কেউ কেউ মনে করেন ধর্মপাল নেপালও জয় করেছিলেন। ধর্মপাল প্রায় ৪০ বছর (৭৮১-৮২১ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব করেন ।
পিতার মতো ধর্মপাল ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। পাল রাজাদের মধ্যে তিনিই সর্বোচ্চ সার্বভৌম উপাধি পরমেশ্বর, পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করেছিলেন। ভাগলপুরের ২৪ মাইল পূর্বে তিনি একটি বৌদ্ধ বিহার বা মঠ নির্মাণ করেন। বিক্রমশীল তাঁর দ্বিতীয় নাম বা উপাধি অনুসারে এটি বিক্রমশীল বিহার' নামে খ্যাত ছিল । নালন্দার মতো বিক্রমশীল বিহারও ভারতবর্ষের সর্বত্র ও ভারতবর্ষের বাইরে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। নবম শতক থেকে ৰাৱো লক্ষক পর্যন্ত এটি সমগ্র ভারতবর্ষের একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। তিব্বতের অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে অধ্যয়ন করতে আসতো এবং এখানকার অনেক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচার্য তিব্বতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিলেন। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর নামক স্থানেও ধর্মপাল এক বিশাল বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সোমপুর বিহার নামে পরিচিত। এই স্থাপত্য জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বসভ্যতার নিদর্শন হিসেবে (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) স্বীকৃত হয়েছে। এর মতো বিশাল বিহার ভারতবর্ষের আর কোথাও এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। ওদন্তপুরেও (বিহার) তিনি সম্ভবত একটি বিহার নির্মাণ করেন। তারনাথের মতে, ধর্মপাল বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার জন্য ৫০টি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রাজা হিসেবে সকল ধর্মাবলম্বী প্রজার প্রতি সমান পৃষ্ঠপোষকতা ছিল পাল যুগের একটি বৈশিষ্ট্য। তাই নিজে বৌদ্ধ হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি ধর্মপালের কোনো বিষেষ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজার ব্যক্তিগত ধর্মের সঙ্গে রাজ্য শাসনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তিনি শাস্ত্রের নিয়ম মেনে চলতেন এবং প্রতিটি ধর্মের লোক যেন নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতেন। নারায়ণের একটি হিন্দু মন্দিরের জন্য তিনি করমুক্ত ভূমি দান করেছিলেন। তিনি যাদের ভূমি দান করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিল ব্রাহ্মণ । ধর্মপালের প্রধানমন্ত্রী গর্গ ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ । তাঁর বংশধরগণ অনেকদিন ধরে পাল রাজাদের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে ধর্মপাল ছিলেন শ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম। পঞ্চাশ বছর পূর্বে যে দেশ অরাজকতা ও অত্যাচারের লীলাভূমি ছিল, তাঁর নেতৃত্বে সেদেশ সহসা প্রবল শক্তিশালী হয়ে উত্তর ভারতে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ধর্মপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবপাল (৮২১-৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) সিংহাসনে বসেন। তিনি পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। পিতার মতো তিনিও বাংলার রাজ্যসীমা বিস্তারে সফল হন। দেবপাল উত্তর ভারতে প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট রাজাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। উত্তর ভারতের বিশাল অঞ্চল তাঁর অধিকারে এসেছিল। উড়িষ্যা ও কামরূপের উপরও তিনি আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন । মোটকথা, তাঁর সময়েই পাল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছিল। দেবপাল বৌদ্ধধর্মের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মগধের বৌদ্ধমঠগুলোর তিনিই সংস্কার সাধন করেন । তিনি নালন্দার কয়েকটি মঠ এবং বুদ্ধপরায় এক বিরাট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। মুঙ্গেরে তিনি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। জাভা, সুমাত্রা ও মালয়ের শৈলেন্দ্র বংশের মহারাজ বালপুত্রদেবকে নালন্দায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠার অনুমতি দান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, এ মঠের ব্যয় নির্বাহের জন্য দেবপাল পাঁচটি গ্রামও প্রদান করেছিলেন। এ ঘটনা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের সাথে বাংলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়।
দেবপাল বিদ্যা ও বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন । দেবপালের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তখন সমগ্র এশিয়ার বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রধান প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বৌদ্ধশাস্ত্রে পারদর্শী ইন্দ্রগুপ্ত নামক ব্রাহ্মণকে তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বা অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছিলেন। এ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই তার শাসন আমলে উত্তর- ভারতে প্রায় হারিয়ে যাওয়া বৌদ্ধধর্ম পুনরায় সঞ্জীব হয়ে ওঠে।
দেবপালের মৃত্যুর পর থেকে পাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর কয়েকজন দুর্বলচেতা অকর্মণ্য উত্তরাধিকারী সিংহাসনে বসেন। তাঁরা পাল সাম্রাজ্যের গৌরব ও শক্তি অব্যাহত রাখতে পারেননি। ফলে পাল সাম্রাজ্য ক্রমেই পতনমুখী হয়। দেবপালের পুত্র প্রথম নিগ্রহগাল থেকে দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকাল ৮৬১ হতে ৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রথম বিগ্রহপালের পুত্র নারারণপাল দীর্ঘকাল (৮৬৬-১২০ খ্রি রাজত্ব করেন। তিনি একজন দুর্বল ও উদ্যমহীন শাসক ছিলেন। ফলে তাঁর রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্যের সীমা ছোট হতে থাকে। নারায়ণ পালের পর একে একে পাল সিংহাসনে বসেন রাজ্যপাল, দ্বিতীয় গোপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপাল। তারা আনুমানিক ১২০ থেকে ৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সময় পাল রাজাদের শাসন ক্ষমতা কেবল গৌড় ও তার আশপাশেই সীমাবদ্ধ ছিল। এসব দুর্বল রাজার সময়ে উত্তর ভারতের চন্দেল ও কলচুরি বংশের রাজাদের আক্রমণে পাল সাম্রাজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয় । ফলে এ সময়ে পাল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম বাংলার অংশবিশেষে কম্বোজ রাজবংশের উত্থান ঘটে ।
এভাবে পাল সাম্রাজ্য যখন ধ্বংসের মুখে, তখন আশার আলো নিয়ে এগিয়ে এলেন দ্বিতীয় বিগ্রহপালের সুযোগ্য পুত্র প্রথম মহীপাল (আনুমানিক ৯৯৫-১০৪৩ খ্রিষ্টাব্দ) । তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো কম্বোজ জাতির বিতাড়ন এবং পূর্ববঙ্গ অধিকার করে পাল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা । এরপর তিনি রাজ্য বিজয়ে মনোযোগ দেন । তাঁর সাম্রাজ্য পূর্ব বঙ্গ থেকে বারাণসী এবং মিথিলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল । সে সময়ে ভারতের দুই প্রবল রাজশক্তি তামিলরাজ রাজেন্দ্র চোল এবং চেদীরাজ গাঙ্গেয়দেবের আক্রমণ থেকে তিনি রাজ্যের অধিকাংশ স্থানে নিজ আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মহীপাল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মের উদার পৃষ্ঠপোষক । পুরাকীর্তি রক্ষায় তিনি যত্নবান ছিলেন । তিনি নালন্দায় এক বিশাল বৌদ্ধমন্দির নির্মাণ করেন । বারাণসীতেও তাঁর আমলে কয়েকটি বৌদ্ধমন্দির নির্মাণ করা হয় । মহীপাল জনকল্যাণকর কাজের প্রতিও মনোযোগী ছিলেন । বাংলার অনেক দীঘি ও নগরী এখনও তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে । তিনি অসংখ্য শহর প্রতিষ্ঠা ও দীঘি খনন করেন । শহরগুলো হলো রংপুর জেলার মাহীগঞ্জ, বগুড়া জেলার মহীপুর, দিনাজপুর জেলার মাহীসন্তোষ ও মুর্শিদাবাদ জেলার মহীপাল নগরী। আর দীঘিগুলোর মধ্যে দিনাজপুরের মহীপাল দীঘি ও মুর্শিদাবাদের মহীপালের সাগর দীঘি বিখ্যাত । সম্ভবত জনহিতকর কাজের মাধ্যমেই মহীপাল এ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন । মহীপালের পঞ্চাশ বছরের রাজত্বকালে পাল বংশের সৌভাগ্য রবি আবার উদিত হয়েছিল । এ জন্যই ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন । পাল সাম্রাজ্যের দ্রুত অবনতির যুগে প্রথম মহীপালের আবির্ভাব না ঘটলে এ সাম্রাজ্যের রাজত্বকালের সময়কাল নিঃসন্দেহে আরও সংকুচিত হতো।
মহীপাল কোনো যোগ্য উত্তরসূরি রেখে যেতে পারেননি । তাই তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্য ভেঙে যেতে শুরু করে । প্রথম মহীপালের পর তাঁর পুত্র ন্যায়পাল (আনু. ১০৪৩-১০৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) ও পৌত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল (আনু ১০৫৮-১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) পাল সিংহাসনে বসেন। এ দুর্বল রাজাদের সময় সুদীর্ঘকাল একের পর এক বিদেশি আক্রমণ মোকাবেলা করতে গিয়ে পাল সাম্রাজ্য যখন বিপর্যস্ত, তখন দেশের অভ্যন্তরেও বিরোধ ও অনৈক্য দেখা দেয় । এই সুযোগে বাংলার বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয় । বাংলার বাইরে বিহার পাল রাজাদের হাতছাড়া হতে থাকে । এভাবে তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে বাংলার পাল সাম্রাজ্য বহু স্বাধীন খণ্ড অংশে বিভক্ত হয়ে যায় । এরপর পাল সিংহাসনে বসেন তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল । তাঁর সময় পাল রাজত্বের দুর্যোগ আরও ঘনীভূত হয়। এ সময় উত্তর বঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের সামন্তবর্গ প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে । ইতিহাসে এ বিদ্রোহ কৈবর্ত বিদ্রোহ' নামে পরিচিত । এ বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কৈবর্ত নায়ক দিব্যোক বা দিব্য । তিনি দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করে বরেন্দ্র দখল করে নেন এবং নিজ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন । বরেন্দ্র অঞ্চল যখন কৈবত্যদের দখলে, তখন পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন দ্বিতীয় মহীপালের ছোট ভাই দ্বিতীয় শূরপাল (আনু. ১০৮০-১০৮২ খ্রিষ্টাব্দ)। অতঃপর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামপাল (১০৮২-১১২৪ খ্রিষ্টাব্দ) সিংহাসনে বসেন । তিনিই ছিলেন পাল বংশের সর্বশেষ সফল শাসক। প্রাচীন বাংলার কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত ‘রামচরিত' থেকে রামপালের জীবনকথা জানা যায় । রামপাল রাজ্যভার গ্রহণ করেই বরেন্দ্র উদ্ধার করতে সচেষ্ট হন । এ বিষয়ে রামপালকে সৈন্য, অস্ত্র আর অর্থ দিয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসেন রাষ্ট্রকূট, মগধ, রাঢ় দেশসহ চৌদ্দটি অঞ্চলের রাজারা। যুদ্ধে কৈবর্তরাজ ভীম পরাজিত ও নিহত হন । এরপর তিনি বর্তমান মালদহের কাছাকাছি ‘রামাবতী' নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন । পরবর্তী পাল রাজাদের শাসনামলে রামাবতীই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। পিতৃভূমি বরেন্দ্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর সাম্রাজ্যের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি মগধ, উড়িষ্যা ও কামরূপের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন ।
পাল বংশের দুর্ভাগ্য রামপালের পরবর্তী শাসকগণ ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল। ফলে তাঁদের পক্ষে পালবংশের হাল শক্ত হাতে ধরা সম্ভব ছিল না। রামপালের পর কুমারপাল (আনু. ১১২৪-১১২৯ খ্রিষ্টাব্দ), তৃতীয় গোপাল (১১২৯-১১৪৩ খ্রিষ্টাব্দ) ও মদনপাল (আনু. ১১৪৩-১১৬১ খ্রিষ্টাব্দ) একে একে পাল সিংহাসনে বসেন । এ সময় যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত । অবশেষে বারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিজয় সেন পাল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাংলায় সেন বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন ।